১০:১৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ১২ মার্চ ২০২৫

বিয়ানীবাজার যেন প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শনের রাজধানী, আছে রাজা-বাদশাহদের নানাস্মৃতি

স্টাফ রিপোর্টার
  • আপডেট সময়ঃ ১১:০৩:৪১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৭ মার্চ ২০২৫
  • / ১৩ বার পড়া হয়েছে।

রাজা-বাদশাহদের বনেদি স্মৃতিবিজড়িত বিয়ানীবাজার উপজেলায় অসংখ্য পুরাকীর্তির নিদর্শন রয়েছে। যা বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বিরল। বিয়ানীবাজারের পূর্ব নাম ছিল পঞ্চখন্ড। তৎকালীন সময়ে পঞ্চখন্ড গহীন জঙ্গল ও টিলা বেষ্টিত ভূমি ছিল। সিলেটের প্রথম রায় বাহাদুর হরেকৃষ্ণ রায় চৌধুরীর পুত্র কৃষ্ণ কিশোর পাল চৌধুরী এখানে একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু হিংস্র জীবজন্তুদের ভয়ে লোকজন সকালবেলা (স্থানীয়ভাষায়ঃ বিহানে) বাজার শেষ করে নিজ নিজ আশ্রয়ে ফিরতেন। বিহানবেলা এই হাট বসতো তাই এর নাম হলো বিহানীবাজার যা কালের আবর্তণে বিয়ানীবাজার নাম ধারণ করে।

১৮৭৮ সালে করিমগজ্ঞ মহকুমা সৃষ্টি করা হলে বিয়ানীবাজার করিমগজ্ঞ মহকুমার অন্তভূক্ত হয়। পরে ১৯৮৩ সালের ১লা আগষ্ট তৎকালীন স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রী জেনারেল শামসুল হক আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ানীবাজারকে উপজেলায় উন্নীত করেন।

রাজপ্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর এই রাজপরগনার উত্তরাধিকারীরা সপরিবারে ভারতে চলে যান। বর্তমানে এই পরগনায় কোনো রাজা নেই। পরগনাজুড়ে আছে তাদের অনেক স্মৃতিবিজড়িত পুরাকীর্তি। বিশেষ করে কারুকাজখচিত রাজপ্রাসাদসহ বিভিন্ন মন্দির দেশি ও বিদেশি পর্যটকদের কাছে অনেক আকর্ষণীয়। কিন্তু এখানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারি ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পুরাকীর্তিগুলো দিন দিন বিলুপ্তির পথে বলে স্থানীয় ইতিহাসবিদদের ভাষ্য। সিলেটের শেষ হিন্দু রাজা গৌড় গোবিন্দের শাসনামলের শেষের দিকে পঞ্চখণ্ডে পাল রাজত্ব বহাল ছিল। তখন এই অঞ্চল রাজা ধর্মপালের অধীনে ছিল। পাল রাজা কালিদাসের পর সপ্তম পুরুষ পর্যন্ত ‘রাজা’ উপাধি ধারণ করে তারা এখানে শাসনকার্য পরিচালনা করে গেছেন স্বাধীনভাবে। সেই সময়ে কাউকেই রাজস্ব দিতে হয়নি।

এখানে প্রাচীন নিদর্শনাদি ও প্রত্নসম্পদ সুপাতলায় হিন্দু তীর্থ শ্রী শ্রী বাসুদেব বাড়ি এবং কষ্টি পাথর নির্মিত বাসুদেব মূর্তি রয়েছে। ৭ম শতাব্দীর কামরূপ নরপতি ভাস্কর বর্মার তাম্রশাসনের ৭টি খন্ডের মধ্যে ৬টি খন্ড এবং গজ (হাতি) চিহ্নিত একটি রাজকীয় সীলমোহর এখানে পাওয়া গেছে। এখানকার বাসুদেব মন্দির সপ্তম শতকে প্রতিষ্ঠিত। সুপাতলা গ্রামের দুর্গাদলই নামে তৎকালীন জয়ন্তীয়া রাজ্যের একজন রাজকর্মচারীর বাড়িতে একটি পুকুর খননের সময় বাসুদেব মূর্তির সন্ধান মেলে। সিলেট অঞ্চলে পাল রাজবংশের অন্যতম স্মারক বিয়ানীবাজারের পাল রাজবাড়ি। ইতিহাস সন্ধানী ভ্রমণপিপাসু ও প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে এই পাল জমিদার বাড়ি ও এখানকার বারোপালের দিঘি প্রিয় স্থান। পাল রাজবাড়ির উত্তরসূরি ভূপতিভূষণ পাল চৌধুরীর মেয়ে সুস্মিতা পাল চৌধুরী জানান, প্রাচীন এই বাড়ির বয়স প্রায় আটশ বছর।

এছাড়াও পন্ডিত রঘুনাথ শিরোমণি পঞ্চদশ শতকের আনুমানিক ১৪৭৭ খ্রিস্টাব্দে পঞ্চখন্ডে জন্মগ্রহণ করেন। বিয়ানীবাজার পৌরশহরের পন্ডিতপাড়ায় রঘুনাথ শিরোমনির স্মৃতি বিজড়িত বহুচিহ্ন এখনো কালের সাক্ষী বহন করছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সম্প্রতি বিয়ানীবাজার উপজেলার প্রাচীণ নিদর্শন নিয়ে জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। জরিপদল পুরাকীর্তির আলামত সংগ্রহ করেছে। শ্রীহট্টের প্রাচীনতম অস্তিত্বের পুরাকীর্তি সম্পর্কে জানার জন্য অনুসন্ধানে আসে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে গঠিত প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের দুই সদস্যের প্রতিনিধি দল। তবে আর বেশীদূর এগোতে পারেনি তারা।

লেখক-গবেষক হাবীব আহমদ দত্ত চৌধুরী বলেন, পঞ্চখন্ড তথা বিয়ানীবাজারের সৌন্দর্য ও প্রত্নতত্ত্বগুলো বাংলাদেশের অহংকার। এরকম একই স্থানে একাধিক পুরাকীর্তি সংবলিত রাজপ্রাসাদ দেশের আর কোথাও দেখা যায় না।

বিয়ানীবাজার উপজেলা নির্বাহী অফিসার গোলাম মুস্তাফা মুন্না বলেন, সিলেট বিভাগের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এই এলাকা। এখানকার ঐতিহাসিক প্রত্ননিদর্শনগুলোকে ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করে আধুনিক সুবিধা সংযোজন করতে পারলে তা বাংলাদেশের অন্যতম সেরা প্রত্নপর্যটন নগরী হিসাবে গড়ে উঠবে।

নিউজটি শেয়ার করুন
ট্যাগসঃ

বিস্তারিত লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষণ করুন

আপলোডকারীর তথ্য

বিয়ানীবাজার যেন প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শনের রাজধানী, আছে রাজা-বাদশাহদের নানাস্মৃতি

আপডেট সময়ঃ ১১:০৩:৪১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৭ মার্চ ২০২৫

রাজা-বাদশাহদের বনেদি স্মৃতিবিজড়িত বিয়ানীবাজার উপজেলায় অসংখ্য পুরাকীর্তির নিদর্শন রয়েছে। যা বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বিরল। বিয়ানীবাজারের পূর্ব নাম ছিল পঞ্চখন্ড। তৎকালীন সময়ে পঞ্চখন্ড গহীন জঙ্গল ও টিলা বেষ্টিত ভূমি ছিল। সিলেটের প্রথম রায় বাহাদুর হরেকৃষ্ণ রায় চৌধুরীর পুত্র কৃষ্ণ কিশোর পাল চৌধুরী এখানে একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু হিংস্র জীবজন্তুদের ভয়ে লোকজন সকালবেলা (স্থানীয়ভাষায়ঃ বিহানে) বাজার শেষ করে নিজ নিজ আশ্রয়ে ফিরতেন। বিহানবেলা এই হাট বসতো তাই এর নাম হলো বিহানীবাজার যা কালের আবর্তণে বিয়ানীবাজার নাম ধারণ করে।

১৮৭৮ সালে করিমগজ্ঞ মহকুমা সৃষ্টি করা হলে বিয়ানীবাজার করিমগজ্ঞ মহকুমার অন্তভূক্ত হয়। পরে ১৯৮৩ সালের ১লা আগষ্ট তৎকালীন স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রী জেনারেল শামসুল হক আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ানীবাজারকে উপজেলায় উন্নীত করেন।

রাজপ্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর এই রাজপরগনার উত্তরাধিকারীরা সপরিবারে ভারতে চলে যান। বর্তমানে এই পরগনায় কোনো রাজা নেই। পরগনাজুড়ে আছে তাদের অনেক স্মৃতিবিজড়িত পুরাকীর্তি। বিশেষ করে কারুকাজখচিত রাজপ্রাসাদসহ বিভিন্ন মন্দির দেশি ও বিদেশি পর্যটকদের কাছে অনেক আকর্ষণীয়। কিন্তু এখানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারি ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পুরাকীর্তিগুলো দিন দিন বিলুপ্তির পথে বলে স্থানীয় ইতিহাসবিদদের ভাষ্য। সিলেটের শেষ হিন্দু রাজা গৌড় গোবিন্দের শাসনামলের শেষের দিকে পঞ্চখণ্ডে পাল রাজত্ব বহাল ছিল। তখন এই অঞ্চল রাজা ধর্মপালের অধীনে ছিল। পাল রাজা কালিদাসের পর সপ্তম পুরুষ পর্যন্ত ‘রাজা’ উপাধি ধারণ করে তারা এখানে শাসনকার্য পরিচালনা করে গেছেন স্বাধীনভাবে। সেই সময়ে কাউকেই রাজস্ব দিতে হয়নি।

এখানে প্রাচীন নিদর্শনাদি ও প্রত্নসম্পদ সুপাতলায় হিন্দু তীর্থ শ্রী শ্রী বাসুদেব বাড়ি এবং কষ্টি পাথর নির্মিত বাসুদেব মূর্তি রয়েছে। ৭ম শতাব্দীর কামরূপ নরপতি ভাস্কর বর্মার তাম্রশাসনের ৭টি খন্ডের মধ্যে ৬টি খন্ড এবং গজ (হাতি) চিহ্নিত একটি রাজকীয় সীলমোহর এখানে পাওয়া গেছে। এখানকার বাসুদেব মন্দির সপ্তম শতকে প্রতিষ্ঠিত। সুপাতলা গ্রামের দুর্গাদলই নামে তৎকালীন জয়ন্তীয়া রাজ্যের একজন রাজকর্মচারীর বাড়িতে একটি পুকুর খননের সময় বাসুদেব মূর্তির সন্ধান মেলে। সিলেট অঞ্চলে পাল রাজবংশের অন্যতম স্মারক বিয়ানীবাজারের পাল রাজবাড়ি। ইতিহাস সন্ধানী ভ্রমণপিপাসু ও প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে এই পাল জমিদার বাড়ি ও এখানকার বারোপালের দিঘি প্রিয় স্থান। পাল রাজবাড়ির উত্তরসূরি ভূপতিভূষণ পাল চৌধুরীর মেয়ে সুস্মিতা পাল চৌধুরী জানান, প্রাচীন এই বাড়ির বয়স প্রায় আটশ বছর।

এছাড়াও পন্ডিত রঘুনাথ শিরোমণি পঞ্চদশ শতকের আনুমানিক ১৪৭৭ খ্রিস্টাব্দে পঞ্চখন্ডে জন্মগ্রহণ করেন। বিয়ানীবাজার পৌরশহরের পন্ডিতপাড়ায় রঘুনাথ শিরোমনির স্মৃতি বিজড়িত বহুচিহ্ন এখনো কালের সাক্ষী বহন করছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সম্প্রতি বিয়ানীবাজার উপজেলার প্রাচীণ নিদর্শন নিয়ে জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। জরিপদল পুরাকীর্তির আলামত সংগ্রহ করেছে। শ্রীহট্টের প্রাচীনতম অস্তিত্বের পুরাকীর্তি সম্পর্কে জানার জন্য অনুসন্ধানে আসে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে গঠিত প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের দুই সদস্যের প্রতিনিধি দল। তবে আর বেশীদূর এগোতে পারেনি তারা।

লেখক-গবেষক হাবীব আহমদ দত্ত চৌধুরী বলেন, পঞ্চখন্ড তথা বিয়ানীবাজারের সৌন্দর্য ও প্রত্নতত্ত্বগুলো বাংলাদেশের অহংকার। এরকম একই স্থানে একাধিক পুরাকীর্তি সংবলিত রাজপ্রাসাদ দেশের আর কোথাও দেখা যায় না।

বিয়ানীবাজার উপজেলা নির্বাহী অফিসার গোলাম মুস্তাফা মুন্না বলেন, সিলেট বিভাগের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এই এলাকা। এখানকার ঐতিহাসিক প্রত্ননিদর্শনগুলোকে ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করে আধুনিক সুবিধা সংযোজন করতে পারলে তা বাংলাদেশের অন্যতম সেরা প্রত্নপর্যটন নগরী হিসাবে গড়ে উঠবে।

নিউজটি শেয়ার করুন